ইতিহাস, সংস্কৃতি আর আর সভ্যতার মিশেলে যে দেশ গোটা দুনিয়াবাসির কাছে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষার সেই ফ্রান্স আজ কাঁদছে । কাঁদছে গোটা নিস শহর। কাঁদছে সভ্য বিশ্ব যেখানে অসভ্যের থাবায় থমকে গেছে মানবতা, থমকে গেছে বিবেক। আর সেই নৃশংসতার প্রতিবাদ করছে মানুষ তাদের মত করে । তাদের সেই প্রতিবাদ আর শোকের সবচেয়ে বড় ভাষা এবার এই হামলার সময় তোলা একটি ছবি যে ছবি আলোড়ন তুলেছে পুরো সোস্যাল মিডিয়ায়। যেমনটি তুলেছিল ভূমধ্যসাগরে ভেসে যাওয়া ছোট্ট শিশু আয়লানের ছবি।
রয়টার্সের আলোকচিত্রী এরিক গাইয়ার তোলা ওই ছবিতে দেখা যায়, রাস্তায় একটি মৃতদেহের পাশে পড়ে আছে একটি পুতুল। সাধারণভাবে এটি হয়তো তেমন কিছু না। উৎসবে আসা কোন বাবা অথবা তার মা হয়তো প্রিয় সন্তানকে অনেক শখ করে কিনে দিযেছিলেন এই পুতুলটি। জানিনা এই হামলায় যে ১০টি ফুটফুটে শিশু মারা গেছে তাদের মধ্যে ঐ শিশুটিও আছে কিনা যে হয়তো হামলার সময় শক্ত করে ধরেছিল শখের পুতুলটি।
ফরাসি বিপ্লবের দিন বাস্তিল দিবসকে স্মরনীয় করতে বৃহস্পতিবার রাতে নিসের ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বিখ্যাত প্রমেনেদ দেজাঙ্গলে চত্বরে এসেছিলেন যারা তারাই আজ বিশ্ববাসির কাছে স্মরণ করার বিষয় হয়ে গেছেন। ফরাসিবাসির কাছে তারাই আজ স্মরণ করার বিষয় হয়ে গেছেন। অনুষ্ঠানের আতশবাজির প্রদর্শনী উপভোগের পর হাজারো মানুষ যখন সাংস্কৃতিক পরিবেশনার অপেক্ষায় তখনই ঘাতক একটি ট্রাক তুলে দিলো জনতার ওপর। প্রায় দুই কিলোমিটা্র রাস্তা জুড়ে মানুষের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হলো ঐ ট্রাক যা কেড়ে নেয় ৮৪টি প্রাণ, যাদের অন্তত ১০ জন শিশু।
এ হামলায় আহত হয়েছেন আরও দুই শতাধিক মানুষ, যাদের ৫২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।
ফ্রান্সের এই বিয়োগান্তক ঘটনায় সারা বিশ্বের সভ্য সমাজ তাদের সমবেদনা জানাচ্ছে। বিশ্ব নেতারা এই ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছেন। তাদের সেই শোকের আর নিন্দা জানানোর ভাষার ক্ষেত্রে উঠে আসছে ঐ ছবিটির প্রসঙ্গ। ইতালির প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজি ফ্রান্সের ওই ঘটনায় সমবেদনা প্রকাশে ওই ছবিটির কথা উল্লেখ করেছেন। তার ভাষায়,
“অপরূপ সুন্দর নিসের ছবি এতোদিন আমরা দেখতাম পোস্টকার্ডে। মৃত্যুর ছবি দেখিনি, যেখানে শবের পাশে পড়ে থাকে পুতুল। এর প্রতিবাদ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”
ছবির অনুকরণে কার্টুন এঁকেছেন ব্রাজিলিয়ান চিত্রশিল্পী কার্লোস লেতাফ। তার ওই কার্টুন চিত্রটিও টুইটারে শেয়ার করছেন হাজার হাজার মানুষ। ছবিতে যে মৃতদেহটির পাশে ছোট্ট-সুন্দর পুতুলটি পড়ে থাকতে দেখা যায়, তার পরিচয় প্রকাশ হয়নি গণমাধ্যমে।
ঘটনার মর্মান্তিকতা বোঝাতে অনেকে আবার এই ছবিটিকে তুলনা করছেন তুরস্কে ভূমধ্যসাগারের পাড় থেকে উদ্ধার সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির সঙ্গে। প্রাণ বাঁচাতে বাবা-মায়ের কোলে চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে সাগড়ে ভেসে গিযেছিল আয়লান । পরিবারের কয়েক সদস্য বাঁচতে পারলেও সলিল সমাধি ঘটেছিল আয়লানের। আয়লানের ছবিটি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সিরীয় শরণার্থী ও যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে সরব হয়েছিল গোটা বিশ্ব। একটি ছবি বদলে দিয়েছিল বিশ্ব জনমত। পাল্টে দিয়েছল জার্মানিসহ অনেক দেশের মনোভাব। শরনার্থীদের আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জার্মানিসহ বেশ কটি দেশ।
নিস শহরে হামলার আরও ছবি আলোচনায় আসচে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যাতে দেখা যায় হামলার পর এখানে- সেখানে পড়ে আছে শিশুদের বহনকারি ট্রলি, খেলনা, জুতো চকলেটের প্যাকেট আরো কত কি?
হামলায় নিহতদের স্মরণে শনিবার থেকে তিনদিন জাতীয় শোক পালন করছে ফ্রান্স। এ হামলার পর ফ্রান্সের মার্সেই শহর কর্তৃপক্ষ শুক্রবার সন্ধ্যায় বাস্তিল দিবসের আতশবাজি উৎসব বাতিল করে।
সভ্যতার ইতিহাসে নতুন কালিমা লেপন করে দিয়েছে এমন নৃশংস হামলা। মানুষ মানুষের প্রতি কতটা নির্মম হতে পারে, কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে তার আরেক কালো সাক্ষী নিস হামলা। বর্তমান দুনিয়ায় সন্ত্রাসের এই ভয়াবহতার প্রতিবাদের সবচেয়ে বড় প্লাটফরম সোস্যল মিডিয়া। এখানে প্রতিবাদে সামিল হতে কোন নিদিষ্ট জনগোষ্ঠি লাগেনা। এখানে প্রতিবাদে সামিল হতে পারে ছোট-বড়, তরুণ-বৃদ্ধ, কালো-সাদা, নারি-পুরুষ সবাই। এখানে যারা প্রতিবাদ করছে তাদের ভাষা আলাদা, তাদের রং আলাদা, তাদের শিক্ষা-সংস্কৃুতি আলাদা। কিন্তু সবার প্রতিবাদের ভাষা এক। সন্ত্রাস চাইনা। শান্তি চাই। রক্ত চাইনা। ফুল চাই। প্রতিবাদ হচ্ছে, প্রতিবাদ হবে। কিন্তু যাদের ইন্ধনে, যাদের প্ররোচনায়, যাদের মদদে বিপদগ্রস্থ হচ্ছে তরুণ সমাজ, ধ্বংস করছে মানব সভ্যতা তাদের বিবেক কি জাগ্রত হবে?
লেখক: সাইদুল ইসলাম ( সাইদ )
সিনিয়র রিপোর্টার
জিটিভি
Be the first to comment